২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের প্রথম বাঘ সম্মেলনে বাংলাদেশসহ ১৩টি রাষ্ট্র নিজ নিজ দেশে বাঘের সংখ্যা এক যুগের মধ্যে দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নিয়েছিল। এর মধ্যে নেপাল বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করেছে। ভারত ও ভুটানও দ্বিগুণের কাছাকাছি নিয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা সামান্য বাড়লেও সেই লক্ষ্য থেকে দূরে আছে। সম্প্রতি বাঘের মৃত্যু ও হত্যা বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ যতটুকু এগিয়েছিল, সেখান থেকেও আবার পিছিয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ রকম পরিস্থিতিতে পালিত হচ্ছে আজ বিশ্ব বাঘ দিবস। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘বাঘ বাঁচাবে সুন্দরবন, সুন্দরবন বাঁচাবে লক্ষ প্রাণ’। আর আগামী বছরের শুরুতে রাশিয়ায় আবারও বাঘ সম্মেলন হতে যাচ্ছে। সেখানে কোন দেশ কতটুকু এগোল, তার হিসাব–নিকাশ হবে।
প্রথম সম্মেলনে প্রতিটি দেশ প্রতি দুই বছরে একবার করে বাঘশুমারি করবে বলে অঙ্গীকার করেছিল। দেশগুলো একটি কর্মপরিকল্পনা করে বাঘ রক্ষায় উদ্যোগ নেবে বলেও জানিয়েছিল। বাংলাদেশ ২০১৪ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে বাঘ রক্ষায় একটি প্রকল্প গ্রহণ করে, যা ২০১৯ সালে শেষ হয়। এরপর সরকার নিজস্ব অর্থায়নে বাঘ রক্ষায় পদক্ষেপ নেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ বলেন, বাঘ রক্ষার জন্য বন বিভাগকে যেভাবে প্রস্তুত করা দরকার, তা এখনো হয়নি। আর ২০১৫ সালের শুমারিতে বাঘের সংখ্যা ১০৬টি আর ২০১৮ সালে ১১৪টি বলা হলেও এর মাধ্যমে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে বলা যাবে না। শেষবার আগের চেয়ে বেশি এলাকায় শুমারি করায় বাঘ কিছুটা বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করা দূরে থাক, আদৌ সুন্দরবনে কোনোমতে টিকে থাকা বাঘগুলো শেষ পর্যন্ত টিকবে কি না, সেই প্রশ্ন করতে হবে। সরকারের উচিত নিজ উদ্যোগে বাঘের সুরক্ষার উদ্যোগ নেওয়া।’
বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে বাঘ সুরক্ষা প্রকল্প ও সুন্দরবন সুরক্ষা নামে দুটি কার্যক্রম শুরু করার কথা ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির কাছে দেওয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল। এর মধ্যে ১০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পটি অনুমোদন হলেও এর অর্থ বরাদ্দ হয়নি। আর ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রস্তাবিত বাঘ সুরক্ষা প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনের সভায় বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন থেকে বলা হয়েছে, আয়বর্ধক কোনো প্রকল্প ছাড়া নতুন কোনো প্রকল্পে অর্থায়ন করা হবে না। বাঘ সুরক্ষা প্রকল্পে ২০২১ সালে বাঘশুমারি করা, সুন্দরবনে আগুন নিয়ন্ত্রণে ওয়াচ টাওয়ার বসানো এবং আগুন নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থাপনা তৈরি করাসহ নানা উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাব ছিল।
প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা বাঘ রক্ষায় “স্মার্ট পেট্রলিং”সহ নানা কর্মকাণ্ড চালু রেখেছি। এ কারণে বাঘের সংখ্যাও বেড়েছে। তবে বাঘ হত্যা ও শিকার বন্ধে আরও কিছু পদক্ষেপ নেব।’
সর্বশেষ ২০১৯ সালে ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাঘসমৃদ্ধ ১৩টি দেশের সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেশের বাঘ সুরক্ষা কার্যক্রমের অগ্রগতির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বে ৩ হাজার ৮৯০টি বাঘ রয়েছে। এর মধ্যে ভারত বাঘের সংখ্যা দেড় হাজার থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ২২৬টি করেছে। নেপাল ১০০টি থেকে বাড়িয়ে ১৯৮টি, ভুটান ৫০টি থেকে ১০৩টি করেছে। থাইল্যান্ড বাঘের সংখ্যা ৯০টি থেকে ১৮৯টি করেছে। আর চীনে বাঘের সংখ্যা সাতটি, লাওসে দুটি, ভিয়েতনামে পাঁচটিতে নেমে এসেছে। আর কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারে বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে ২০০৪ সালের পায়ের ছাপ গুনে করা জরিপে ৪৪০টি বাঘ থাকার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ক্যামেরা ফাঁদের মাধ্যমে করা জরিপে বাঘের সংখ্যা বেরিয়ে আসে ১০৬টি। এরপর ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আরেকটি শুমারি করে জানায়, বাঘের সংখ্যা ১১৪টি। ২০২১ সালে বাংলাদেশের আরেকটি জরিপ করার কথা থাকলেও তা এ বছর না–ও হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বন্য প্রাণিবিষয়ক সংস্থা ওয়াইল্ড টিমের প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশকে বাঘের সংখ্যা বাড়াতে হলে বন বিভাগের পাশাপাশি স্থানীয় অধিবাসীদের নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।